can't preview the image.

কিভাবে আমি শিশু সংগঠক হলাম'

‘বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা’ গঠন ও কিছু স্মৃতি

(চতুর্থ পর্ব)

১.
বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার প্রথম শাখা ‘চট্টগ্রাম মহানগর”। দ্বিতীয় শাখা ‘মুন্সিগঞ্জ জেলা”
বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার উপদেষ্টা সংগ্রহের পাশাপাশি গঠনতন্ত্র তৈরী, শাখা গড়ার কার্য্ক্রম একসাথেই চলছে। আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি যখন বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার জন্ম তখন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। যে কারণে সেই আন্দোলনে অংশগ্রহন যেমন আমাদের নাগরিক দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি সংগঠনকে সাংগঠনিক রূপ দেয়া আমাদের ঈষ্পাত সমান দৃঢ়তা ছিল। সেভাবেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
গঠনতন্ত্র তৈরী করার প্রক্রিয়া
ওবায়েদ আনন্দ, মহীউদ্দিন মানুসহ আমরা বসলাম বিমানদার অফিসে। গঠনতন্ত্র তৈরীর বিষয়ে কথা হয়।আনন্দদা আমাকে বললেন- মনসফ, তুমি পটভূমিকাটি লিখো।আমি সাথে সাথে বললাম এইটি আপনাকে লিখতে হবে। আমি পারবো না। তখন তিনি আবার বললেন, তুমি আগে একটা কিছু দাঁড় করাও। তারপর আমি ঠিক করে দেব। ওবায়েদ আনন্দের একটা গুণ ছিল তা হচ্ছে, সব সময় কোন কাজ করতে তিনি অভয় দিতেন। সাহস দিতেন। তবুও গঠনতন্ত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ্ বিষয়ের জন্য পটভূমিকা লেখা আমার পক্ষে একটু অসম্ভবই বটে। আনন্দদার সাহসে আমি দায়িত্ব নিলাম এবং পরবর্তী একটা তারিখ ঠিক হলো যেদিন আমারা সবাই মিলে গঠনতন্ত্র পূর্ণাঙ্গ করবো। সেদিনের বৈঠকের মাত্র ৩/৪ দিন পর আমার অফিসে বসলাম।রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উত্তর গেইটে আমার অফিস। নব্বইয়ের দশকে তখন আমি্ কিছু সময়ের জন্য একটি হোটেলের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে ছিলাম।গঠনতন্ত্র চুড়ান্ত করতে আমার অফিসেই বসলাম সবাই। আমরা তিনজন ছাড়া সৈয়দ শফিউল আজম হেলালও ছিলেন সেদিন। তারপর আমার লেখা সংগঠনের পঠভূমিকা উপস্থাপন করলাম। আনন্দদা পটভূমিকার প্রশংসা করলেন। তারপর তিনি নিজে কয়েকটি লাইন সংযোজন করে যে পটভূমিকা তৈরী হলো সেই পটভূমিকাই বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার আজকের গঠতন্ত্রে সংযোজিত হলো।তারপর মনোগ্রাম, পতাকার ডিজাইন করার জন্য একজন আর্টিস্ট এর সাথে কথা বলার পরামর্শ্ দিলেন সবাই। সাথে সাথে আমি আমার নিজের তৈরী করা একটি মনোগ্রামের নমুনা দেখালাম।সবাই একটু আশ্চর্য্ হলো আমার অঙ্কিত মনোগ্রাম দেখে। একবাক্যে সেদিন সেই মনোগ্রামও সবাই মিলে চুড়ান্ত করলাম। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার আজকের মনোগ্রাম ও পতাকার ডিজাইন আমার নিজের করা।
আপনারা হয়তো একটু আশ্চর্য্ হবেন, আমি তো আর্টিস্ট নই। তাহলে বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার মতো জাতীয় সংগঠনের মনোগ্রাম পতাকার ডিজাইন করা কিভাবে আমার পক্ষে সম্ভব হলো।
সেই গল্প বলছি এখন। আঁকাআঁকির বিষয়ে বলতে হলে একটু পিছনে ফিরে যেতে হয়।মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে আমি তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র।লেখা পড়া নেই। স্কুল বন্ধ । মক্তব খোলা ছিল। ভোর বেলা মক্তবে ধর্মীয় শিক্ষা শেষে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে এদিক ওদিক ঘোরফেরা করতাম বন্ধুদের সাথে। খেলাধুলা নিয়েই ব্যস্ত বন্ধুদের সাথে। খেলতে খেলতে যখন মুক্তিযোদ্ধাদের বৈঠক ঘরের সামনের রাস্তায় খড়ের তৈরী বল নিয়ে খেলতাম, তখন মাঝে মাঝে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হতো আমাদের(আমরা খেলার সঙ্গীরা)।
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ ও চট্টগ্রাম কদমমোবারক এতিমখানার প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর ছেলে শাহজাহান ইসলামবাদী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের বৈঠক চলছিল তাদের বাড়ীর বৈঠক খানায়।তাদের বাড়ীর সীমানা প্রাচীর ঘেষা আমাদের বাড়ী। আমরা ঐ বাড়ির সামনে যারা খেলছিলাম তাদেরকে ডেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা (অভীক ওসমান সম্ভবত) বললেন, ঐদিক থেকে (মৌলভাবাজারের দিক থেকে) দল বেঁধে কেউ (রাজাকার পাকবাহিনী) আসতে দেখলে আমাদের খবর দিও। আমরা শিশু দল কিছুই তো বুঝিনা তখন। তাঁরা এখানে কী করছেন! দল বেঁধে কারাই বা আসবেন সেই সব মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে বাড়ীতে যখন আসতাম পড়ালেখার পরিবর্তে আঁকাআঁকিতে মনোনিবেশ করতাম নিজেকে। এখনকার মতো গ্রামীন স্কুলে তখন ছবি আঁকার বিষয় ছিলনা তখনকার সময়ে। নিজের সখের বশেই আঁকা হতো। আমার সেই আকাঁআঁকির অভ্যেসটা এখনো আছে। আমার ছবি অংকনের বিষয়ে বিমানদার(বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা সাবেক সভাপতি)অবদানও কম নয়। উনি বাংলার বাণী শাপলা কুঁড়ির আসরের গল্পদাদু। ছোটদের লেখা নিয়ে প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হতো শাপলা কুড়িঁর আসর। লেখা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমি বিমানদাকে সহযোগিতা করতাম। একদিন একটি গল্পের সাথে হাতে আঁকা ছবি দিতে হবে। বাংলার বাণীর আর্টিস্ট আসেননি। আমি গল্পের সাথে সামঞ্জস্য রেখে একটি ছবি এঁকে বিমানদার হাতে দিলাম। আমার আঁকা ছবিটি গল্পের সাথে ছাপিয়ে দিলেন তিনি। আমার অঙ্কিত ছবির পাশে আমার সংক্ষিপ্ত নাম লিখে দিলাম।কী যে আনন্দ আমার। সেই থেকে শাপলা কুঁড়ির পাতায় স্কেচ করার সুযোগ হতো। সখের বশে আঁকাআঁকির অভ্যেস থেকে বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার মনোগ্রাম ও পতাকার ডিজাইন করার দুঃসাহসটা পাই।
চট্টগ্রাম মহানগর বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার প্রথম ও দ্বিতীয় শাখা মুন্সিগঞ্জ জেলা শাখা।
বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা ৩রা আগষ্ট আত্মপ্রকাশ এর সংবাদ পরদিন থেকে বিভিন্ন জাতীয় ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশ হবার পর থেকে বিভিন্ন স্থান থেকে শাখা গড়ার সংবাদ আসতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার প্রথম শাখা ‘চট্টগ্রাম মহানগর”। দ্বিতীয় শাখা ‘মুন্সিগঞ্জ জেলা”।
ধাপে ধাপে অন্যান্ন জেলা ও থানা শাখা গঠন হতে থাকে।
চট্টগ্রাম মহানগর শাখার প্রথম সভাপতি মোঃ নাসিম, সাধারণ সম্পাদক আনছারুল হক।
মুন্সিগঞ্জ জেলা শাখার প্রথম সভাপতি মুকুল মৃধা ও প্রথম সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান শরীফ(বর্তমানে কেন্দ্রীয় সভাপতিমন্ডলীর সদস্য।)
২.
বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার প্রথম অনুষ্ঠান ও বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার কেন্দ্রীয় সফর চট্টগ্রাম মহানগর আয়োজিত অনুষ্ঠানে
বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা প্রতিষ্ঠালাভ করার পর প্রথম কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সফর করেন চট্টগ্রাম জেলায়। চট্টগ্রাম মহানগর আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সফর শুরু হয় ১৯৯০ সালের ১৬ ডিসেম্বর। অনুষ্ঠানটি ছিল বিজয় দিবস এর অনুষ্ঠান। ঢাকা থেকে পত্র দিয়ে চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি আনছারুল হকের সাথে অনুষ্ঠানের বিষয়ে যোগাযোগ শুরু হলো। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের প্রথম চট্টগ্রাম মহানগর আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনের কথা জানালে তিনি একবাক্যে রাজী হয়ে যান।অলি খাঁ মসজিদের মোড়ে বিশাল প্যান্ডেলে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে সাধারণ সম্পাদক ওবায়েদ আনন্দ, সহ সভাপতি মহিউদ্দিন মানু এবং আমি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হই।
চট্টগ্রাম থেকে কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা জহীর কাজীও প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। নিজের মধ্যে এক অন্য রকম অনুভূতি কাজ করছে তখন। কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে ঢাকার বাইরে প্রথমবারের মতো অংশগ্রহন। অনুষ্ঠানটি শুধু বিজয় দিবসের হলেও একটুবাড়তি উৎসব ছিল বটে। মাত্র ১০ দিন আগে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দিবস আর স্বৈরাচারের পতনের কারণে এবারের বিজয় দিবস অন্যমাত্রা যোগ করেছে।
বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা চট্টগ্রাম মহানগর আয়োজিত দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন। সকাল ১১টায় শুরু হলো বিজয় র্যা লী। অলিখাঁ মসজিদের মোড় থেকে বিজয় র্যা লী এগিয়ে যাচ্ছে মূল শহরের দিকে। চেতনার একুশের শহীদ মিনার হচ্ছে শেষ গন্তব্য। চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজের পাশ দিয়ে পাহাড়ী উঁচু নিচু পথ মাড়িয়ে এগিয়ে চলছে র্যা লী। র্যা লী যখন ব্রিটিশ আন্দোলনের অন্যতম বীর সৈনিকের স্মৃতি বিজড়িত জে এম সেন হলের সামনে পৌঁছে তখন অলিখাঁ মসজিদ মোড় থেকে আসা শিশু কিশোরদের অংশগ্রহনে র্যা লীটি বিশালত্ব অর্জন করে।শিশুরা বহন করছিল বিভিন্ন শ্লোগানসহ প্ল্যাকার্ড্। র্যা লীতে আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবির পোষ্টার প্ল্যাকার্ড্ বহন করছিলশিশু কিশোররা। র্যালীর পেছনে বড়দের অংশগ্রহন র্যালীর বিশালত্ব বাড়িয়ে দেয়।শিশু কিশোরদের র্যালীটিকে স্বাগত জানিয়ে আশে পাশের দালান কোঠা থেকে অভিনন্দন ছিল দেখার মতো। এ যেন মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মিছিল।আন্দরকিল্লা মোড়ে এসে অনেকগুলো মিছিল এসে মিশেছিল এক মোহনায়। সুশৃংখলভাবে বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর র্যালী যখন এগিয়ে যাচ্ছিল তখন ছাত্রদলের একটি মিছিল থেকে বেগম খালেদা জিয়ার ছবি লাগিয়ে দেয় আমাদের র্যালীর অগ্রভাগের ব্যানারের উপর। তখন আমাদের কর্মীদের মাঝে উত্তেজনা ছড়ানোর আগেই। যে কোন অঘটন ঘটার আগে কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা জহীর কাজী এগিয়ে যান ছাত্রদল কর্মীর দিকে। তিনি রুদ্রমূর্তি ধারণ করে খালেদা জিয়ার ছবি সম্বলিত পোষ্টার কেন দেয়া হলো র্যালীর ব্যানারের উপর একথা বলতেই সাথে সাথে ছবিটি নিয়ে দৌড় দেয় ছাত্রদল কর্মীটি। তারপর খুব শান্ত ও ধীর গতিতে এগুতে এগুতে শহীদ মিনারে এসে শেষ হলো বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার প্রথম শাখা চট্টগ্রাম মহানগর আয়োজিত বিজয় দিবসের র্যালী।
তারপর বিকেলের আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। সদ্য গড়ে ওঠা একটা শিশু সংগঠন এতো বড় অনুষ্ঠান করতে পারে ভাবাই যায়না।চট্গ্রাম অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার নতুন উদ্যোমে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে কেন্দ্র থেকে অংশ নেয়া আমরা তিন কর্মকতার মধ্যে্। তারপর সেই রাতে আমরা তিনজন ঢাকা ফিরে নতুন নতুন কর্মসূচীর উদ্যোগ নিলাম। তারপর শুধু এগিয়ে চলা, এগিয়ে যাওয়া। সেই প্রেরণাই আমাদের আজকের অবস্থান।
ছবি পরিচিতি
১। প্রথম শাখা চট্টগ্রাম মহানগর আয়োজিত প্রথম অনুষ্ঠান- ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯০।
২। দ্বিতীয় শাখা মুন্সিগঞ্জ জেলা শাখা আয়োজিত একুশের অনুষ্ঠান- ১৯৯১
২। চট্টগ্রাম মহানগর আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্যরত ওবায়েদ আনন্দ(বর্তমানে প্রয়াত), মহীউদ্দিন মানু এবং
আমি।
৩। প্রথম গঠনতন্ত্রের প্রচ্ছদ।
৪। ছাত্রদলের কর্মী কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার ব্যানারের উপর সেঁটে দেয়া খালেদার ছবি। র্যালীর
সামনে কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা জহীর কাজী ছাত্রদল কর্মীর দিকে তেড়ে যাচ্ছেন।
৫। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে অতিথিবৃন্দসহ চট্টগ্রাম মহানগর নেতৃবৃন্দ।
৬। বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার র্যালীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দের মটর সাইকেল
শোভাযাত্রা।
৭। শাপলা কুঁড়ির আসরের সাহিত্য পাতায় গল্প কবিতার আমার আাঁকা দু’টি স্কেচ।
৮। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে আাঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্বলিত পোষ্টার।